তুমি_আমার_মনের_মানুষ (পর্ব- ২ থেকে শেষ পর্যন্ত)

 




সন্ধ্যে সাতটার লগ্নে রাতুল-প্রিয়ন্তির বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের সমস্ত নিয়ম কারণ পালন করে রাতুলদের বাড়ি যেতে যেতে মধ্যরাত হয়ে গেল। প্রিয়ন্তি আজ সারাদিন কিছুই খায়নি। বিয়ের শেষে বড়োমা জোর করে কয়েক গাল ভাত মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছিল। সারা রাস্তা বমি করতে করতে বিধস্ত অবস্থায় রাতুলদের বাড়িতে পৌঁছালো। বাসায় পৌঁছেই রাতুল টোপরটা সোফায় ফেলে নিজের ঘরে চলে গেল। প্রিয়ন্তি ড্রয়িংরুমে বসে আছে। এই বাসাটা প্রিয়ন্তির চেনা। তিনবছরে অনেকবার আসা হয়েছে। তবে আজকের মতো এমন অদ্ভুত অনুভূতি কখনো হয়নি। রাতুলের ছোটোবোন রিতু এসে প্রিয়ন্তির পাশে বসল। রিতু এবার ইন্টার ১ম বর্ষের ছাত্রী। আজ পরীক্ষা ছিল৷ তারজন্য বিয়েতে যেতে পারেনি। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে দেখল ওরা এসে গেছে। বলল,

“বউদি চলো ফ্রেশ হয়ে নেবে।”

রিতুর মুখে এই প্রথম ‘বউদি’ ডাকটা শুনে প্রিয়ন্তির যেন কেমন লাগল। রিতুর সাথে আগে থেকেই প্রিয়ন্তির বেশ সখ্যতা ছিল। তবে রিতু সবসময় প্রিয়ন্তিকে প্রিয়ন্তিদি বলে ডাকতো। অবশ্য এখন সম্পর্কটাই তো বদলে গেছে। আগে ছিল বউদির ছোটো বোন। আর এখন সে নিজেই রিতুর বউদি হয়ে গেছে। আজ একবারও রাতুলের সাথে প্রিয়ন্তির কথা হয়নি। শুধু শুভদৃষ্টির সময় সবার অনুরোধে খুব অল্প সময়ের জন্য দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হয়েছিল। তারপর বাকি নিয়মগুলো দুজনই জড়বস্তুর মতো শুধু একটার পর আরেকটা পালন করে গেছে। প্রিয়ন্তি রিতুর সাথে ওঠে চলে গেল। রিতু প্রিয়ন্তিকে রাতুলের ঘরে নিয়ে গেল। রাতুল শুয়ে ছিল। ওদের দেখে উঠে ব্যালকনিতে চলে গেল। রিতু লাগেজ খুলে একটা সুতি শাড়ি বের করে দিল প্রিয়ন্তিকে। বলল,

“কাপড়টা পাল্টে নাও। ফ্রেশ লাগবে। আমি হেল্প করব?”

প্রিয়ন্তি ইতস্তত করে বলল,

“আমি স্নান করব।”

“বেশ, বাথরুমে যাও। ওয়েট তোমার চুলের খোঁপাটা খুলে দেই।”

পার্লারের মেয়েটা প্রিয়ন্তির মাথায় একগাদা ক্লিপ দিয়ে খোঁপা করে দিয়েছে। রিতু তেলের বোতল নিয়ে এলো। প্রিয়ন্তির চুলের খোঁপা সময় নিয়ে খুব সাবধানে খুলে দিল। প্রিয়ন্তি সুতি শাড়ি আর ব্লাউজ নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। 


প্রায় বিশ মিনিট পর স্নান সেরে বের হলো প্রিয়ন্তি। রাতুল তখনো ঘরে আসেনি। ঘরে বসে আছে রাতুলের মা রিক্তাদেবী আর রাতুলের বোন রিতু। মা পইপই করে বলে দিয়েছে শ্বশুর-শাশুড়ীর সামনে মাথায় ঘোমটা দিবি। প্রিয়ন্তি রিক্তাদেবীকে দেখে মাথায় আলতো হাতে কাপড় তুলে দিল। আজ কেন যেন ওনাদের সামনে খুব লজ্জা লাগছে৷ প্রিয়ন্তি ধীর পায়ে এগিয়ে এসে নিচু কণ্ঠে বলল,

“মৃণালিনী কোথায়?”

রাতুলের দেড় বছরের মেয়েটার নাম মৃণালিনী। রিক্তাদেবী বলল,

“মৃণালিনী ঘুমে।”

প্রিয়ন্তি ইতস্তত করে বলল, 

“ওকে বরং এখানে নিয়ে আসতেন।”

রিক্তাদেবী বলল,

“আজ থাক। এখন আনতে গেলে কাঁচাঘুম ভেঙে যাবে। তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন? সিঁথিতে সিঁদুর পরে খেয়ে নাও।”

প্রিয়ন্তি চুলগুলো মুছে, মাথা আছড়ে সিঁথি ভর্তি রাতুলের নামে সিঁদুর পরলো। অথচ দুদিন আগেও মানুষটা সম্পর্কে প্রিয়ন্তির জামাইবাবু ছিল। দুদিনের ব্যবধানে এখন শুধুই ‘জামাই’ হয়ে গেছে। কথাগুলো ভাবতেই প্রিয়ন্তির গা শিরশির করে উঠলো। রিক্তাদেবী প্রিয়ন্তিকে সিঁদুর পরতে দেখে বলল,

“তোমার বোন সায়ন্তি এরকম একটা কুৎসিত কাণ্ড ঘটাবে আমরা কেউ কল্পনাও করিনি। আমার ছেলে ছুটিতে বাড়ি এলে ওর সাথে প্রায়ই অশান্তি করতো। আমরা ভাবতাম স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তো ঝগড়া লাগেই। এ আর নতুন কী! আমার ছেলেটাও চাপা স্বভাবের জানো! বউ যে বিয়ের পরও পরকীয়া করে জেনেও কখনো আমাদের জানায়নি। অবশ্য আমার ছেলেই বা কতটুকু জানতো। এতো নিখুঁত অভিনয় করতো তোমার বোন। কতটা বেয়াদব আর ছিনাল হলে, দেড়বছরের বাচ্চা ফেলে রসিক নাগরের হাত ধরে পালিয়ে যায়! মা’গী’র কলিজা আছে।” 

সায়ন্তি যতই খারাপ হোক। হাজার হলেও সম্পর্কে প্রিয়ন্তির দিদি। দিদির প্রাক্তন আর প্রিয়ন্তির বর্তমান শাশুড়ী নামক মানুষটার মুখে দিদির নামে এতো কুৎসিত কথা শুনতে প্রিয়ন্তির একটুও ভালো লাগলো না। রিতু বলল,

“আহ্..মা চুপ করো তো!”

“তুই চুপ কর। বলতে দে আমাকে। শোনো প্রিয়ন্তি এতকিছুর পরও তোমাকে আমরা বউ করে কেন এনেছি জানো? দুটো কারণে, 

এক. তোমার ভাগ্নিকে মাতৃস্নেহে বড়ো করবে তুমি। আর দুই. ওই মাগি যদি কোনোদিন ফিরে আসে, তাহলে দেখবে কী হারাইছে সে। এবং সেই অনুতাপে সারাজীবন আফসোস করে জ্বলেপুড়ে মরবে।

তোমার কোনোকিছুর আমরা অভাব রাখব না। আমরাও দেখব, ওর নাগর ওকে কতোদিন সুখে রাখে। কতো শখ করে বউ এনেছিলাম। অথচ আমাদের মুখে চুনকালি মেখে কীভাবে ঘর ছাড়লো। এখনো ভাবলে আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। যাইহোক এখন এই টপিক বাদ দেই। তুমি খেয়ে নাও। এই রাতুল খেয়ে যা বাবা?”


পুরোটা সময় প্রিয়ন্তি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে রইলো। কেবল তো শুরু এই কথাগুলো সারাজীবন শুনতে হবে প্রিয়ন্তিকে। বেশ বুঝতে পারছে প্রিয়ন্তি। রিতু ফিসফিস করে বলল,

“মায়ের কথায় কিছু মনে করো না বউদি। আসলে মা সেকেলে চিন্তাচেতনার মানুষ। তোমার বোনের তিনবছরের সংসার ফেলে চলে যাওয়াটা মা এখনো মেনে নিতে পারেনি।”

রিক্তাদেবী বলল,

“ও হ্যাঁ বউমা আর একটা কথা বলি! তোমার বোন তো তোমার বাবা-মা আমাদের সবার মুখে চুনকালি দিয়েছে। তুমিও এমন কিছু করো না। যাতে তোমার বাবা-মায়ের শিক্ষার প্রশ্ন উঠে। এমনিতেও তোমার বোন যা করেছে। তোমার ভালো ঘরে বিয়ে হতো না। তোমার রাজ-কপাল বুঝলে!”

কেমন রাজ-কপাল বেশ বোঝা হয়ে গেছে প্রিয়ন্তির৷ বিয়ের একদিনও যায়নি। অথচ এখুনি যা শুরু করেছে এই মহিলা। বাকি জীবন কীভাবে কাটাবে কে জানে! মা-বাবাও এই চিন্তাভাবনা থেকেই রাতুলের সাথে বিয়ে দিয়েছে। মা প্রায়ই আফসোস করে বলতো সায়ন্তির ঘটনার জের ধরে প্রিয়ন্তির ভালো ঘরে বিয়ে হবে না। এতে অবশ্য প্রিয়ন্তির কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। 

মায়ের ডাক শুনে রাতুল ঘরে এলো। রিক্তাদেবী বলল,

“খেয়ে নে বাবা!”

রাতুল একবার আঁড়চোখে প্রিয়ন্তির দিকে তাকালো। মাকে বলল,

“খেতে ইচ্ছে করছে না মা।”

“প্রিয়ন্তি তুমি কী খাবে?”

পেটে খিদে চু চু করছে। তবে ‘খাব’ বলতে খুব লজ্জা লাগছে প্রিয়ন্তির। রাতুল বলল,

“খাবার রেখে যাও মা। খিদে লাগলে খেয়ে নেব আমরা।”

“আচ্ছা বাবা। এবার একটু রেস্ট নে তোরা। রিতু চল ঘুমাবি।”


মা আর বোন উঠে চলে যেতেই রাতুল আস্তে করে দরজাটা চাপিয়ে দিল। ধীর কণ্ঠে বলল,

“খেয়ে নাও প্রিয়ন্তি।”

প্রিয়ন্তি খিদেয় অস্থির বোধ করছে। তবুও ভদ্রতা করে বলল,

“আপনি খাবেন না?”

“না।”

প্রিয়ন্তি আর কথা বাড়ালো না। হাত ধুয়ে খেতে বসল। মাছ আর ডাল দিয়ে অর্ধেক ভাত মেখে খেয়ে এক গ্লাস জল ঢকঢক করে গিলে ফেলল। পেট ভরে গেল। রাতুল খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে একমনে ফোন স্ক্রল করছিল। 

প্রিয়ন্তির খাওয়া শেষ হতেই রাতুল বলল,

“এদিকে আসো প্রিয়ন্তি।”

এখন প্রিয়ন্তির ভয় ভয় করছে। এই মানুষটাকে একটানা তিনটা বছর জামাইবাবু ডেকে এসেছে প্রিয়ন্তি। ভাগ্যক্রমে মানুষটা এখন প্রিয়ন্তির বর। দিদি কেন যে এতোবড় একটা ভুল করলো! তার খেসারত এখন প্রিয়ন্তিকে দিতে হবে। 

প্রিয়ন্তি গুটিগুটি পায়ে এসে রাতুলের সামনে দাঁড়াল। রাতুল ফোনটা বিছানায় রেখে চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে নিল। প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুমি এখন কেমন অনুভব করছো প্রিয়ন্তি?”

প্রিয়ন্তি রাতুলের কথার মানে ঠিক বুঝতে পারলো না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রাতুলের মুখের দিকে তাকালো। 


রাতুল চোখ থেকে চশমাটা খুলে শার্টের কোণা দিয়ে মুছে নিয়ে চোখে পরলো। তারপর আস্তে করে উঠে বাবু হয়ে বসল রাতুল। বলল,

“তোমার দিদির সাথে আমার তিনবছরের সংসার ছিল। না চাইতেও তোমার দিদিকে সব দিয়েছি আমি। কতো রিকুয়েষ্ট করেছি আমার সাথে যেয়ে থাকতে! একবার আমার খুব নির্জন একটা এলাকায় পোস্টিং হলো। শীতের রাতে একা একা মন টিকতো না। তোমার দিদিকে কতবার বলেছি, চলো আমরা একসাথে থাকি। তোমার দিদি আমার বাবা-মাকে দেখে রাখার অজুহাতে আমার সাথে গেল না। বিয়ের আটমাস পর জানতে পারলাম তোমার দিদির গোপন প্রেমের কথা। যেদিন হাতে-নাতে তোমার দিদিকে প্রমাণ সহ ধরলাম, তোমার দিদি আমার পাদু’টো জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলো। আমার কাছে ক্ষমা চাইলো। আর জীবনেও তার সাথে সম্পর্ক রাখবে না। এই বলে, আমার গা ছুঁয়ে কথা দিল। প্রথম প্রথম মেনে নিতে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। তবুও সম্মান নষ্ট হবার ভয়ে মেনে নিয়েছি। তাছাড়া ততদিনে তোমার দিদির মায়ায় ভীষণ ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম। তারপর তো মৃণালিনী তোমার দিদির পেটে এলো। ভেবেছিলাম এবার ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আমার দেড় বছরের মেয়েকে ফেলে তোমার দিদি পালিয়ে গেল। আচ্ছা আমার কী দোষ ছিল বলোতো? আমার কথা বাদই দিলাম! আমার ছোট্ট মেয়েটার কী দোষ ছিল? যাওয়ার হলে বিয়ের আগেই পালিয়ে যেতো। তা-ও না গেলে আমার বাচ্চা ওর গর্ভে আসার আগে যেতো। কিন্তু ও তা করলো না। আমার মেয়েটাকে এতিম করে দিয়ে ওর সো কল্ড প্রেমিকের ভালোবাসার টানে পালিয়ে গেল। আমি তো প্রথমে মানতেই পারিনি। কতো রাত নির্ঘুম কেটেছে। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইনি। অন্তত বিয়ের আগে একবার তোমার সাথে সামনাসামনি কথা বলে নিতে চেয়েছিলাম। মা এমন ভাবে আমাকে বুঝালো। অন্যকেউ না। একমাত্র তুমিই নাকি আমার মেয়ের বেস্ট মা হবে। তাছাড়া তোমার দিদির ওইরকম একটা কুৎসিত ঘটনার পর তোমার ভালো ঘরে বিয়ে হওয়ার সম্ভবনা কম। সবকিছু বিবেচনা করে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তোমাকে বিয়ে করেছি। আমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শুরু করার আগে আমাকে স্পষ্ট করে একটা কথা বলো তো প্রিয়ন্তি!”

প্রিয়ন্তি জড়তা নিয়ে বলল, “কী কথা?”

“তোমারও কী তোমার দিদির মতো অন্য কোথাও রিলেশন আছে?”

প্রিয়ন্তি এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। পায়ের নিচে কী যেন শিরশির করছে। মিথ্যে বলবে না সত্যি বলবে সঠিক বুঝতে পারছে না প্রিয়ন্তি। ওর বড্ড অস্থির লাগছে।

“কী হলো প্রিয়ন্তি?”

প্রিয়ন্তি শুকনো ঢোক গিলল। গলা শুকিয়ে চৌচির। রাতুলের সন্দেহ গাঢ় হলো। বিড়বিড় করে বলল,

“বেছে বেছে এই ধরনের মেয়েগুলোই কেন যে আমার ভাগ্যে জুটে!”

প্রিয়ন্তি মাথা নিচু করে বলল,

“ছিল।”

রাতুলের মনটা তিতা বিষে ভরে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

“মানে এখন নেই বলতে চাচ্ছো?”

“হ্যাঁ মানে…না মানে…”

রাতুল প্রিয়ন্তির একহাত মুঠো করে ধরলো। ভয়ে প্রিয়ন্তির বুক ধুকপুক করছে। পেটের ভেতরে কী যেন কামড়ে ধরেছে। গা গুলিয়ে উঠছে। রাতুল চাপা কণ্ঠে বলল,

“প্রেমই যখন করতে আমাকে বিয়ে করলে কেন? এনিওয়ে তোমার দিদির মতো তোমারও কী আমাকে ঠকানোর ইচ্ছে আছে? লিসেন প্রিয়ন্তি ওই ধরনের ইচ্ছে যদি থেকে থাকে। এখুনি আমার বাসা থেকে চলে যাবে তুমি। তোমাদের জন্য বার বার আমি অপমানিত হতে পারব না। তোমাদের মানসম্মান না থাকলে কী হবে, এই সমাজে আমাদের মানসম্মান আছে। কী হলো কথা বলছো না কেন? একা যেতে ভয় পাচ্ছো? চলো আমি তোমাকে দিয়ে আসছি।”


রাতুল প্রিয়ন্তির হাতখানা ছেড়ে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে গেল। প্যান্টের পকেটে ফোন ঢুকিয়ে নিয়ে আবারও প্রিয়ন্তির হাতখানা শক্ত করে ধরলো। প্রিয়ন্তির চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল জমলো। ভেজা কণ্ঠে বলল,

“আমি কোথাও যাব না।”

রাতুলের রাগ চড়ে গেল। প্রিয়ন্তিকে ছেড়ে দিয়ে ফোনটা বিছানায় আছড়ে ফেলল। নিজের মাথার চুলগুলো টেনে ধরে বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে প্রাণপনে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। বলল,

“কোথাও যাবে না মানে কী? এই প্রিয়ন্তি তোমার প্রেমিকও কী বেকার? তারমানে তুমিও তোমার দিদির মতো আমার সাথে অভিনয় করবে? যেদিন তোমার বেকার প্রেমিক চাকরি পাবে সেদিনই আমাকে ফেলে চলে যাবে। তাই তো? এক ভুল তো আমি বার বার করব না প্রিয়ন্তি। তোমাকে এখুনি যেতে হবে!”

“তাহলে আমাকে বিয়ে করেছেন কেন?”

রাতুল বলল,

“বিয়ে করেছি সংসার করতে। তোমাদের মতো মেয়েরা তো আবার পরকীয়ায় আসক্ত। স্বামীর সংসার ভালো লাগে না।”

“আমি কী একবারও বলেছি সংসার করব না।”

“লোক দেখানো সংসার তো করবেই। তোমার দিদিও করেছিল। নাগিনীটা আমাকে বুঝতেই দেয়নি তার মনে কী চলছে। এতো নিখুঁত অভিনেত্রী!”

“আপনি এতো উত্তেজিত হচ্ছেন কেন?”

“উত্তেজিত হবো না বলছো? তোমরা দুইবোন বার বার আমাকে ঠকানোর ছক কষবে আর আমি রিলাক্স থাকবো। তুমি পারতে রিলাক্স থাকতে?”

“আমাদের ব্রেকাপ হয়ে গেছে।”

“সে বেকার বলে ব্রেকাপ করেছো নিশ্চয়ই? কতোদিনের সম্পর্ক ছিল?”

“ছয় মাসের।”

“তার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলে?”

“ছিঃ..এসব কী বলছেন?”

“ছয়মাসে সে তোমাকে কিছুই করেনি বলতে চাচ্ছো।”

প্রিয়ন্তি অকপটে বলল, 

“শুধু হাত ধরেছে।”

“এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে প্রিয়ন্তি? আরে আজকালকার মেয়েরা এতই সস্তা হয়ে গেছে। মেয়েগুলো একমাসেই ছেলেদের বেডে চলে যায়। সেখানে তো ছয়মাস।”

“এসবে খুব অভিজ্ঞতা দেখছি। তা কয়টা মেয়েকে চিনেন আপনি?”

“তোমার বোনের চরিত্রই তো ঠিক ছিল না। তোমাকে কীভাবে বিশ্বাস করি।”

“হাতের পাঁচ আঙুল কী কখনো সমান হয়?”

“তোমরা দুইবোন সমানই।”

“এতই যখন অপছন্দ। তাহলে বিয়ে করেছেন কেন?”

“তখন তো আর জানতাম না। তুমিও প্রেম করো। তোমাকে অন্তত ভালো ভেবেছিলাম।”

“খারাপের কী দেখলেন?”

“যারা প্রেম করে। তাদের ভালো হওয়ার চান্স নেই। এরা নিজেও সুখে থাকে না। অন্যদেরও সুখে থাকতে দেয় না। মাঝখান থেকে আমাদের মতো ছেলেদের জীবন নষ্ট হয়।”

“আমাকে একদম দিদির সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না।”

“তোমার দিদির থেকেও বেশি খারাপ তুমি।”

প্রিয়ন্তি আচমকা রাতুলের শার্টের কলার টেনে ধরলো। টলমল চোখে রাতুলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“কী করেছি আমি?”


প্রিয়ন্তির পদ্ম পুকুরের মতো স্বচ্ছ টলমলে চোখের দিকে তাকিয়ে রাতুলের খুব মায়া হলো। প্রিয়ন্তির মায়া মায়া চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরার আগেই রাতুল সযত্নে মুছে দিল। প্রিয়ন্তি রাতুলের হাতখানা তীব্র অভিমানে সরিয়ে দিল। রাতুল দ্রুত নিজেকে খোলসে মুড়িয়ে নিয়ে বলল,

“চলো প্রিয়ন্তি।”

প্রিয়ন্তি ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,

“এখন আমি কোথাও যাব না। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”

রাতুল বিরস মুখে বলল,

“আমি তোমাকে বউ বলে মানি না প্রিয়ন্তি। দ্বিতীয়বার আমার ঠকে যাওয়ার আর কোনো ইচ্ছে নেই।”

কথাগুলো বলেই রাতুল ব্যালকনিতে চলে গেল। সম্পর্ক বদলে গেলে অনুভূতিও বোধহয় বদলে যায়। নাহলে রাতুল ঘরে নেই দেখে, প্রিয়ন্তি শুতে পারছে না কেন! প্রিয়ন্তি অনেকটা সময় চুপটি করে খাটে বসে রইল। এতক্ষণ ঘুমে দুচোখ বুঁজে এলেও এখন চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। প্রিয়ন্তি উঠে দাঁড়াল। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে গিয়ে ব্যালকনির দরজায় দাঁড়ালো। রাতুল একমনে সিগারেট টানছে। সিগারেটের বিকট গন্ধে প্রিয়ন্তির মাথা ধরে গেল। প্রিয়ন্তি আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। ঘরে গিয়ে শুয়ে পরলো। বাকি রাতটুকু এপাশ-ওপাশ করে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পরলো প্রিয়ন্তি।


ঘুম থেকে উঠতে বেশ বেলা হয়ে গেল প্রিয়ন্তির। পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম না হওয়ার কারণে মাথা ভার ভার লাগছে। চোখদুটো জ্বলছে। বাসি কাপড় পাল্টাবে কী! স্নান সেরে, বসার ঘরে গিয়ে দেখল, সবাই থমথমে মুখে বসে আছে। রিতু প্রিয়ন্তিকে দেখে একটু হাসার চেষ্টা করলো। রিক্তাদেবী বলল,

“ঘুম হলো তোমার?”

বেলা করে ঘুম থেকে ওঠার জন্য প্রিয়ন্তির খুব লজ্জা লাগছে। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। রিতু বলল,

“বউদি আসো জলখাবার খেয়ে নাও?”

রিক্তাদেবী চোখ গরম করে মেয়ের দিকে তাকাল। রিতু দমে গেল। রিক্তাদেবী বলল,

“এখানে আসো প্রিয়ন্তি?”

গতকাল রাতেও তো বউমা বলে ডাকছিল৷ আজ আবার কী হলো! নাম ধরে ডাকছে কেন! সর্বনাশ রাতুল কী প্রিয়ন্তির বয়ফ্রেন্ডের কথা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। প্রিয়ন্তি শুকনো ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে রিক্তাদেবীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রিক্তাদেবী বলল,

“পাশে বসো।”

প্রিয়ন্তি বসতেই রাতুলের বাবা উঠে ঘরে চলে গেল। এখন হয়তো মেয়েলি ব্যাপার নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে৷ এখানে তার থাকা আর উচিত হবে না। রিক্তাদেবী বলল,

“রাতুলের সাথে কী গতকাল রাতে তোমার ঝগড়া হয়েছিল?”

প্রিয়ন্তি ভয়ে ভয়ে বলল,

“কেন?”

“এতো কেন কেন করছো কেন? যা বলছি তার উত্তর দাও!”

“না তো।”

“তাহলে দুদিন ছুটি থাকা সত্বেও রাতুল আজ কর্মক্ষেত্রে চলে গেল কেন?”

প্রিয়ন্তি চমকে উঠল। রাতুল চলে গেছে! কখন?



প্রিয়ন্তি চমকে উঠল। রাতুল চলে গেছে! কখন? প্রিয়ন্তিকে একবার বলে যাওয়ারও প্রয়োজন বোধ করল না। অবুঝ অভিমানে প্রিয়ন্তির মনটা খারাপ হয়ে গেল। অথচ ওর তো খুশি হওয়ার কথা ছিল। রিক্তাদেবী বলল,

“এখুনি সময় স্বামীকে আঁচলে বাঁধার। তোমার বোনের বেলায় যে ভুল করেছি। একই ভুল দুবার করব না। তোমাকেও রাতুলের কাছে কিছুদিন পর পাঠিয়ে দেব। স্বামী-স্ত্রী একসাথে থাকলে খারাপ চিন্তা আর মাথায় আসবে না। সংসারেও মন বসবে।”


খেতে বসে একটার বেশি লুচি খেতে পারলো না প্রিয়ন্তি। পেট পাকাচ্ছে। হাত ধুয়ে উঠে গেল। রিতুর সাথে রিক্তাদেবীর ঘরে গিয়ে মৃণালিনীকে কোলে নিল। মেয়েটা প্রিয়ন্তির কোলে এসে খিলখিল করে হাসছে। কিছুক্ষণ কোলে থেকে নামার জন্য অস্থির হয়ে গেল। রিক্তাদেবী প্রিয়ন্তিকে মৃণালিনীর সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে বলল,

“আজ থেকে আমার নাতনির সমস্ত দায়িত্ব তোমার হাতে তুলে দিলাম বউমা। মৃণালিনী দিদিভাই বড়ো হলে তোমরা আরেকটা বাচ্চা নিও৷ আমাদের কোনো সমস্যা নেই। তবে ওকে কখনো বুঝতে দিও না। তুমি ওর সৎমা। সারাজীবন মাতৃস্নেহে তোমার মেয়ের পরিচয়ে বড়ো করো ওকে।”

প্রিয়ন্তি মাথা নেড়ে আচ্ছা বলল। তারপর মৃণালিনীকে নিয়ে রাতুলের ঘরে চলে গেল। ঘরে এসেও মন টিকলো না প্রিয়ন্তির৷ আননোন নাম্বার থেকে কে যেন ফোন দিচ্ছে। একবার ভাবলো ফোনটা ধরবে না। যদি রাতুল হয় সেই ভেবে ফোনটা রিসিভ করল প্রিয়ন্তি৷ বলল,

“হ্যালো কে?”

দেবু বলল,

“একরাতেই আমাকে ভুলে গেছো প্রিয়ন্তি?”

“তুমি ফোন দিয়েছো কেন?”

“বাহ্..একরাতেই এই অবস্থা। তারমানে তোমার জামাই খুব আদর-সোহাগ করেছে তোমাকে।”

প্রিয়ন্তি রাগান্বিত হয়ে বলল,

“তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি?”

“একটু ভালো করে কথা বলো প্রিয়ন্তি। বেশিকিছু তো চাই না তোমার কাছে!”

“ফোনটা রাখো।”

“তুমি প্লিজ আমার কাছে চলে আসো প্রিয়ন্তি!”

“আমার বিয়ে হয়ে গেছে।”

“তো কী হয়েছে? আমার কোনো আপত্তি নেই।”

“বাট আমার আপত্তি আছে।”

“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে প্রিয়ন্তি।”

“আগে ভাবা উচিত ছিল।”

“ভালোবাসা তো কারো জীবনে বলে-কয়ে আসে না।”

“সেইটা তোমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। তবে আমি সম্পর্কে যাওয়ার আগে তোমাকে বেশকিছু কন্ডিশন দিয়েছিলাম। তখন তুমি একবাক্যে মেনে নিলেও এখন কেন মানতে পারছো না। তাছাড়া তুমি অত্যন্ত খারাপ একটা লোক। আর আমি তো আগেই বলেছিলাম। আমি কখনো বাবা-মায়ের অবাধ্য হবো না। শুধু শুধু আমার পেছনে সময় নষ্ট করো না।”

“তুমি অত্যন্ত লোভী একটা মেয়ে। নাহলে তোমার দিদির বেশি বয়সী বরের সাথে বিয়ে বসতে পারতে না।”

“আর কিছু বলবে?”

“প্রিয়ন্তি প্লিজ এখনো সময় আছে। চলে আসো না!”

“অসম্ভব।”

“কেন?”

“আমি অন্যকারো বউ।”

“আর আমাদের ভালোবাসা।”

“আমরা রিলেশনে ছিলাম। এখন নেই। তোমার কু’প্রস্তাবের জন্যই ব্রেকাপ করতে বাধ্য হয়েছি। ভালোবাসা আদৌও হয়েছিল নাকি আমার সঠিক জানা নেই। কারণ তুমি অত্যন্ত ভবঘুরে একটা ছেলে।”

“এরজন্যই বুঝি তুমি সুগার ড্যাডি ধরেছো?”

“সুগার ড্যাডি কাদের বলে জানো তো? যারা বৃদ্ধ। লিসেন আমার বরের এতটাও বয়স না। অনলি ৩৪।”

হাসলো দেবু। ফোনের এপাশে দেবুর হাসির শব্দে প্রিয়ন্তির মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। চট করে ফোনের লাইন কেটে দিয়ে নাম্বারটা ব্লক লিস্টে ফেলে দিল। না এভাবে হবে না। খুব দ্রুত সিমটা পাল্টে ফেলতে হবে। দিদি যে ভুল করেছে। এই একই ভুল প্রিয়ন্তি কখনো করবে না। রাতুলেরও জানা উচিত। সব মেয়ে একরকম হয় না। খারাপ হয় না।


রাতুলের কথা ভাবতে ভাবতে ফোনের স্ক্রীণে রাতুলের নাম্বার ভেসে উঠল। নাম্বারটা এখনো ‘জামাইবাবু’ নামে সেভ করা। আনমনেই হেসে ফেলল প্রিয়ন্তি। ফোন রিসিভ করতেই রাতুল বিদ্রুপ করে বলল,

“নিশ্চয়ই তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে প্রেমালাপ করছিলে?”

প্রিয়ন্তি কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেল। প্রেমালাপ না করলেও দেবুর সাথে যে এতক্ষণ ফোনে কথা বলছিল। এটা তো আর মিথ্যা না। রাতুল বলল,

“কী হলো? এখন চুপ কেন!”

“আপনি ফোন দিয়েছেন কেন?”

“তোমার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। মায়ের কাছে শুনলাম মৃণালিনী নাকি তোমার কাছে। আমার মেয়ের সাথে কথা বলতেই ফোন দিয়েছি। এনিওয়ে তুমি কবে যাবে প্রিয়ন্তি?”

“কোথায় যাব আমি?”

“তোমার বাড়ি যাবে না তোমার প্রেমিকের হাত ধরে ভেগে যাবে। সেটা তো আর আমি জানি না।”

“আপনি আমাকে না বলে চলে গেছেন কেন?”

“হু আর ইউ? তুমি আমার কে?”

প্রিয়ন্তি বলব না বলব না করেও মুখ ফসকে বলে ফেলল,

“আমি আপনার বউ।”

“কী বললে, আবার বলো?”

“আগামীকাল আমাদের বৌভাত। আপনি দ্রুত বাসায় চলে আসুন।”

“আজব! আমি তোমার ভাত কাপরের দায়িত্ব নেব কেন?” 

“তাহলে কে নেবে?”

“এই আমাকে কী বোকা ভাবো তোমরা?”

“(নিশ্চুপ।)”

“এখনো সময় আছে। প্লিজ চলে যাও তুমি।”

“বউ পালার মুরোদ নেই, বিয়ে করেছেন কেন?”

“থাপ্পড় মেরে গালদুটো লাল করে দেব। বেয়াদব মেয়ে কোথাকার! তোমার মতো দশটা বউ পালার…” 

“এই ওয়েট, একটাই আগে পালুন না।”

“জেনেশুনে তোমার পেছনে আমি শুধু শুধু সময় নষ্ট করব না প্রিয়ন্তি। মায়া খুব খারাপ। একবার সহ্য করে গেছি। তুমি মায়ায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে মাঝপথে ছেড়ে চলে যাবে৷ তা আমি মানবো না।”

“আমি কী একবারও বলেছি, আমি চলে যাব?”

“আমি আর বিশ্বাস করি না। তোমার বোনের রক্ত তো তোমার শরীরেও বইছে। বেঈমানী তোমাদের রক্তে মিশে গেছে।”

“বার বার দিদির কথা বলেন কেন?”

“কী বলেছি?”

“আপনি কী দিদিকে এখনো ভুলতে পারেননি?”

“আশ্চর্য তোমার এইকথা মনে হচ্ছে কেন?”

“কী জানি! বার বার আমাদের কথোপকথনের মাঝে দিদিকে টেনে আনেন। এখনো কী ভালোবাসেন দিদিকে?”

“ঘৃণা করি। প্রচণ্ড ঘৃণা করি তোমার দিদিকে। আমার কথা বাদই দিলাম। দেড়বছরের বাচ্চা ফেলে কীভাবে চলে গেল নাগিনীটা?”

“কখনো যদি দিদি আপনার জীবনে ফিরে আসে। মেনে নিবেন?”

“গলা টিপে মেরে ফেলব ওকে আমি।”

“আপনার তো সে ক্ষমতা আছে। তাহলে এখুনি মেরে দিন।”

“এত তাড়াতাড়ি মারব না। ও কী ভেবেছে। ও আমার জীবন থেকে চলে গেলে আমি ভেঙ্গে পরবো। আমি দেবদাস হবো। না.. ওকেও বুঝতে হবে। ওর থেকেও হাজার গুন সুখী হবো আমি, সুখে রাখবো আমার 

বউকে। এমন একদিন আসবে, আমার সুখ দেখে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে ও। আফসোস করবে। অনুশোচনায় দগ্ধ হবে। সেদিন আর ফেরার পথ থাকবে না।”

“আপনি এখনো দিদিকে ভালোবাসেন।”

“এনাফ প্রিয়ন্তি, আমার মেজাজ বিগড়ে দিও না।”

“আগামীকাল আমার ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান। আমার বাড়ির লোকও আসবে। আমি অপেক্ষায় থাকবো!”

“আমি যাব না।”

“আমি আপনার হাত থেকেই ভাত-কাপড় নেবো।”

“তোমার বাবা-মায়ের সাথে আগামীকাল চলে যাবে তুমি। যদি না যাও। তোমার সম্পর্কে সবকিছু বলে দেব আমার মাকে।”

“আমি অপেক্ষায় থাকবো।”

“জেদ করো না প্রিয়ন্তি। ভাত কাপড়ের পরে কী হবে জানো তো? তোমাকে তো আর দুবেলা ফুল, তুলসীপাতা দিয়ে পূজো দেবার জন্য বিয়ে করিনি!”

“আমি তো একবারও বলিনি।”

“আমার এতো কাছে এসেও আমাকে বাজে ভাবে ঠকিয়ে চলে যাবে। তা আর আমি মেনে নেবো না।”



মৃণালিনী খেলতে খেলতে ব্যথা পেয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে কেঁদে দিল। প্রিয়ন্তি চট করে মৃণালিনীকে কোলে তুলে নিল। গালে, কপালে আদর দিয়ে বলল,

“কী হয়েছে সোনা?”

মৃণালিনী আঁধো আঁধো বুলিতে বলল,

“মা..মা..মা..মা….”

‘মা’ ডাক শুনে প্রিয়ন্তির অদ্ভুত অনুভূতি হলো। জন্ম না দিয়েও যে মা হওয়া যায়। আর মা ডাক শোনার অনুভূতি যে এত মধুর হয়। তা প্রিয়ন্তির জানা ছিল না। প্রিয়ন্তি মৃণালিনীর মাথাটা নিজের বুকের ভেতর আলতো করে চেপে ধরলো। এত শান্তি লাগছে কেন? এতদিনের সব কষ্ট, সব অভিযোগ এক নিমিষেই মিলিয়ে গেল। প্রিয়ন্তি বিড়বিড় করে বলল,

“আর একবার মা বলে ডাক সোনা!”

মৃণালিনীর কান্না থেমে গেছে। ছোটো ছোটো হাত দিয়ে প্রিয়ন্তির গাল, মুখ, চোখ ছুঁয়ে আদর করে দিচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে। ছোটোবেলা থেকেই বাচ্চার প্রতি দুর্বলতা আছে প্রিয়ন্তির। ছোটো বাচ্চা দেখলেই গাল টিপে আদর করে দিতো, কোলে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতো। মৃণালিনীকেও কম যত্ন করেনি প্রিয়ন্তি। যখন দিদি আঁতুড় পালতে ওদের বাড়ি গেল। প্রায়ই মৃণালিনীকে কোলে নিয়ে বসে থাকতো প্রিয়ন্তি৷ ফোনে বাবুর ছবি তুলতো, ভিডিও করতো, বাবুকে গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াতো, কাজল দিয়ে দিতো। দিদি রাতে একদম জেগে থাকতে পারতো না। এদিকে বাচ্চাটা রাতে একদম ঘুমাতে চাইতো না। প্রিয়ন্তি কোলে নিয়ে হাঁটতো। মৃণালিনীর জন্মের পর থেকেই প্রিয়ন্তির কাছে বেশিরভাগ সময় থেকেছে। এরজন্য মৃণালিনীর প্রতি আগে থেকেই টান, ভালোবাসা একটু বেশিই অনুভব করে প্রিয়ন্তি। দিদি তো হেসে হেসে প্রায়ই বলতো, মৃণালিনীকে নিয়ে যেমন ভাব করিস তুই। মনে হয়, বাচ্চাটা আমার না তোর।

দিদির কথাই বোধহয় ফলে গেল। জন্ম দিলেও দিদি কখনো মৃণালিনীকে নিয়ে সিরিয়াস ছিল না। প্রায়ই বিরক্ত হয়ে বলতো, এখন একদম বাচ্চা নিতে চাইনি। কীভাবে যে পেটে এলো! প্রিয়ন্তিও যে দিদির ব্যাপারে একটু আধটু জানতো না। ঠিক তা নয়। কতবার কতভাবে দিদিকে বুঝিয়েছে প্রিয়ন্তি। দিদি প্রিয়ন্তির কথা কানেই তুলতো না। প্রায়ই বিরক্ত হয়ে বলতো। ভালোবাসার তুই কী বুঝিস। খবরদার আমার ব্যাপারে নাক গলাবি না প্রিয়ন্তি। মায়ের অতিরিক্ত আদরে দিদিটা একটু বেশিই একগুঁয়ে আর জেদি ছিল। 


প্রিয়ন্তি মৃণালিনীকে ফিডারে দুধ গুলিয়ে খাইয়ে দিল। তারপরে ইউটিউবে সার্চ দিয়ে দেখল, দেড়বছরের বাচ্চাকে কী কী খাওয়ানো যাবে। 

সবজি খিচুড়ি, ফলের পিউরি, ফলের জুস, ডিম সহ আরও অনেককিছুর চার্ট স্ক্রিনশট দিয়ে রাখলো। সবকিছু তৈরি করার পদ্ধতিও দেখে নিল। 


রিক্তাদেবী ঘরে এসে দেখল, প্রিয়ন্তি মৃণালিনীকে গল্পচ্ছলে দুধ খাওয়াচ্ছে৷ মেয়েটা ইদানীং কিছুই খেতে চায় না। খাওয়া নিয়ে খুব নখরা করে। মৃণালিনীকে খাওয়াতেও অনেক সময় লেগে যায়। রিক্তাদেবীর মেজাজ খারাপ হলেই এতটুকু বাচ্চাকে বকাঝকা করতো। মৃণালিনী যদিও বকা বুঝে না। তবে ধমক খেয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে কেঁদে দিতো। পরে রিতু এটাসেটা দেখিয়ে মৃণালিনীর কান্না থামাতো। মায়ের কষ্ট হয় দেখে, রাতুল মেয়েকে নিয়ে যেতে চাইতো। ছেলে সারাদিন অফিসে পরে থাকে। ওতোটুকু মেয়েকে দেখে রাখবে কে! কাজের মেয়েদের আজকাল বিশ্বাস নেই। তাই রিক্তাদেবী নাতনিকে ছেলের কাছে দেওয়ার সাহস পেতো না। ছেলেটার কিছুদিন আগে পোস্টিং হয়েছে ঘিওরে। ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসার’ পদে আছে। অফিসের পাশেই বিশাল এক বাংলোতে রাতুল থাকে। রিক্তাদেবীর ইচ্ছে মৃণালিনী সহ প্রিয়ন্তিকে রাতুলের কাছে পাঠিয়ে দেবে। যে যুগ পড়েছে। স্বামী-স্ত্রী একসাথে থাকায় ভালো। রাতুলটা কেন যে এভাবে হুট করে চলে গেল। তিনি শত ভেবেও বুঝতে পারছে না। প্রিয়ন্তির বাড়ির লোকের কাছে কী জবাব দেবেন তিনি। রাতুল যদি বৌভাতের আগে না আসে। কিছু একটা বানিয়ে বলতে হবে। যদিও হঠাৎ রাতুলের কাজ পরে যাওয়ার কথা শুনলে সবাই বিশ্বাস করবে। ছেলেটা কতবড় অফিসার। কত দায়িত্ব তার।


রাতে মৃণালিনীকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল প্রিয়ন্তি। নিজেও খেয়ে নিয়ে মৃণালিনীর পাশে শুয়ে পরলো। এই ঘরে একটা সময় দিদি-জামাইবাবুর কত ছবি টানানো ছিল। বিয়ের ছবি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় ঘুরতে যাওয়ার কতশত ছবি। এখন আর দিদির একটা ছবিও নেই। সব ছবি সরিয়ে ফেলেছে। দিদি যে এইরকম একটা জঘন্য কাজ করবে। তা কেউ ভাবতেও পারেনি। রাতুলের সাথে প্রিয়ন্তির বিয়ে ঠিক হওয়ার পর সারাক্ষণ ভাবতো প্রিয়ন্তি। কীভাবে রাতুলের সাথে মানিয়ে নেবে। দিদির বরকে নিজের বর বলে ভাবতেই পারতো না প্রিয়ন্তি। তবে এখন আর ততটা খারাপ লাগে না। এই বিয়েটা মন থেকে মানতে কষ্ট হলেও মেনে নিয়েছে প্রিয়ন্তি। আজ যদি রাতুলের সাথে প্রিয়ন্তির বিয়ে না হতো। তাহলে রাতুল অন্যকাউকে একসময় ঠিকই বিয়ে করতো। রাতুলের বউ তো আর মৃণালিনীকে মাতৃস্নেহে আদর করতো না। ভালোবাসতো না। মৃণালিনীটা কষ্টে দিন পার করতো। হয়তো ঠিকমতো খেতেও পেতো না মেয়েটা। খবরে প্রায়ই দেখা যায়, সৎ মায়েরা কীভাবে বাচ্চাদের টর্চার করে। সেসব ভেবেই তো গা শিউরে উঠে। প্রিয়ন্তি ঘুমন্ত মৃণালিনীর কপালে গভীর চুমু এঁকে দিল। মৃণালিনীর গালে আলতো করে হাত রেখে, বিড়বিড় করে বলল,

“আমি আজ তোকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম মা, তোকে আমি এতটাই ভালোবাসা, আদর-যত্ন দিয়ে বড়ো করব, কখনো তোর জন্মদাত্রী মায়ের অভাব বোধ করতেই দেব না। তুই শুধু আমার মেয়ের পরিচয়েই বড়ো হবি।”

মৃণালিনী ঘুমের ঘোরে হেসে দিল। প্রিয়ন্তির চোখদুটো ভিজে উঠল। ফোনটা হাতে নিল। রাতুল আর ফোন দেয়নি। প্রিয়ন্তি কী একবার ফোন দেবে রাতুলকে? মানুষটা কী ভাববে!

ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। রাতুল হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে। প্রিয়ন্তি ফোন থেকে রাতুলের নাম্বারটা ডিলিট করে দিল। তারপর নতুন করে সেভ করলো ‘মৃণালিনীর বাবা’ নামে। ঠিক তখনই রাতুল ফোন দিল। প্রিয়ন্তি ফোন রিসিভ করতেই রাতুল বলল,

“এখনো যাওনি?”

“রাতদুপুরে এগুলো বলার জন্য ফোন দিয়েছেন?”

রাতুল কথা খুঁজে পেল না। বলল,

“মৃণালিনী কী করে?”

“ঘুমায়।”

“তোমার কাছে?”

“হ্যাঁ।”

“খাইয়ে দিয়েছো?”

“হুঁ।”

“তুমি কী আগামীকাল সত্যি সত্যিই চলে যাবে প্রিয়ন্তি?”

“না।”

“কেন যাবে না?”

“কেন কথার কোনো উত্তর নেই আমার কাছে।”

“তুমি নিজে থেকে না গেলে আমি কিন্তু মাকে বলতে বাধ্য হবো।”

“এখনো বলেননি কেন? এখুনি ফোন করে বলে দেন।”

“সময় হলে বলব।”

“আপনি বাড়ি আসবেন কবে?”

“তুমি চলে গেলে।”

“মৃণালিনী মা ছাড়া বড়ো হবে।”

“ওকে নতুন মা এনে দেব।”

“তারমানে আবারও বিয়ে করার ইচ্ছে আছে আপনার?”

রাতুল ঠোঁট টিপে হাসল। কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“যতদিন পারফেক্ট একটা বউ না পাচ্ছি। ততদিন বিয়ে করেই যাবো।”

“ছিঃ…”

“তুমি প্রেম করলে সমস্যা নেই। তোমার বোন পরকীয়া করলে সমস্যা নেই। অথচ আমি বিয়ে করলেই সমস্যা।”

“লুচু।”

“তোমার বোন।”

“ফোন রাখুন।”

“কেন এখন রাত জেগে বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলবে নাকি?”

“আপনাকে এতদিন আমি অত্যন্ত ভালো একজন মানুষ ভাবতাম। বিয়ে না-হলে জানতেই পারতাম না আপনি একটা মিচকে শয়তান।”

রাতুল মৃদু ধমক দিয়ে বলল,

“মুখ সামলে কথা বলো প্রিয়ন্তি।”

প্রিয়ন্তি চুপ হয়ে গেল। রাতুল বলল,

“খুব শীঘ্রই ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেব।”

প্রিয়ন্তির বুকের ভেতর কেঁপে উঠল


“খুব শীঘ্রই ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেব।”

প্রিয়ন্তির বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। চোখদুটো লাল হয়ে গেল। রাতুলের সাথে ডিভোর্স হয়ে গেলে তো মৃণালিনীকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। মৃণালিনী কখনো মায়ের স্নেহ, আদর পাবে না। মেয়েটা সারাজীবন মানসিক কষ্ট নিয়ে বড়ো হবে। প্রিয়ন্তি তা সহ্য করতে পারবে না। যারা একবার বিশ্বাস করে ঠকে যায়। তারা আর দ্বিতীয়বার কাউকে সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। রাতুলের তো কোনো দোষ নেই। সবকিছুর জন্য দিদি দায়ী। রাতুল ফোনের লাইন কেটে দিতেই প্রিয়ন্তির অদ্ভুত কষ্ট হলো। অনেকক্ষণ নিঃশব্দে কাঁদলো। কান্নার সঠিক কারণ খুঁজে পেল না। তবে কাঁদতে খুব ভালো লাগছে। মনটাও আস্তে আস্তে হালকা হয়ে গেল। একসময় ঘুমিয়ে গেল প্রিয়ন্তি।


ভোরের আলো ফুটতেই প্রিয়ন্তির ঘুম ভেঙে গেল। ব্যালকনিতে রোদের ঝলমলে আলো এসে উপচে পড়ছে। প্রিয়ন্তি স্নান সেরে মৃণালিনীর জন্য সবজি খিচুড়ি রান্না করতে রান্নাঘরে গেল। রিক্তাদেবী প্রিয়ন্তিকে দেখে বলল,

“রাতুলকে কতবার ফোন দিয়ে আসতে বললাম। হঠাৎ কী একটা জরুরি কাজ পরে গেছে দেখে এখন আসতে পারবে না। পরে বড়ো করে বৌভাতের অনুষ্ঠান করা যাবে। তুমি এই নিয়ে আবার মন খারাপ করো না প্রিয়ন্তি।”

প্রিয়ন্তির মনটা সত্যি সত্যিই খারাপ হয়ে গেল। তবে শাশুড়ীকে বুঝতে দিল না। মাথা নেড়ে আচ্ছা বলল। রিক্তাদেবী বলল,

“কী করবে?”

“মৃণালিনীর জন্য খাবার বানাবো।”

“আচ্ছা বানাও। ও হলো বিমলা। তুমি তো ওকে চিনোই। ওর কাছে জিজ্ঞেস করে নাও। কোথায় কী রাখা আছে। আমি যাচ্ছি। আর হ্যাঁ একটু দুধ চা করো তো!”


বিমলা এই বাড়িতে দীর্ঘদিন কাজ করে। তিনবছরে অনেকবার প্রিয়ন্তির সাথে বিমলার দেখা হয়েছে। বিমলা মাসির স্বামী নেই। একটা বিবাহিত মেয়ে আছে। মেয়েটা দিব্যি স্বামীর সংসার করছে। এই বাড়ির মানুষই মেয়েটাকে ভালো ঘর দেখে বিয়ে দিয়েছে। 

প্রিয়ন্তি বলল,

“মাসি কী কী সবজি আছে?”

বিমলা লুচি বেলছিল। উঠে এসে বলল,

“তোমার কোন কোন সবজি লাগব?”

“লাউ, পেঁপে, মিষ্টিকুমড়া, আলু। আছে?”

“পেঁপে নেই। আর তিন পদ আছে।”

“তাহলে আমাকে একটু এনে দাও না?”

বিমলা সবকিছু প্রিয়ন্তিকে হাতে হাতে এগিয়ে দিল। প্রথমে চা করে বিমলাকে দিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ীর জন্য পাঠিয়ে দিল। তারপর অল্প চাল-ডাল আর সবজি তেল, নুন দিয়ে মৃণালিনীর জন্য সবজি খিচুড়ি রান্না করে, ব্লেন্ডারে মিহি করে নিল। একটা বাটিতে ঠাণ্ডা করতে দিয়ে ঘরে চলে গেল প্রিয়ন্তি। দেখল, মৃণালিনী এখনো ঘুমে। মৃণালিনীর জামা, কাঁথা ধুয়ে দিয়ে ব্যালকনিতে মেলে দিল। ততক্ষণে মৃণালিনী ঘুম থেকে উঠে বসে বসে কাঁদছে। একবার ঘুমের ঘোরে ফিডার খাইয়ে দিয়েছে। এখন বেলা হয়ে গেছে দেখে, ওর হাত-মুখ মুছিয়ে দিয়ে, সবজি খিচুড়ি এনে খাইয়ে দিল। প্রথমে মেয়েটা খেতে চাইলো না। মুখে নিয়ে থু করে ফেলে দিল। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গল্পচ্ছলে খাওয়াতে সক্ষম হলো প্রিয়ন্তি। রিতু একবার জলখাবার খেতে ডেকে গেছে। সবার সাথে বসে প্রিয়ন্তিও খেয়ে নিয়েছে। রাতুলের হঠাৎ কাজ পরে গেছে। তাই আজ বৌভাত হবে না। এক ফাঁকে মাকেও ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে প্রিয়ন্তি৷ মা প্রথমে একটু গাইগুঁই করেছে। পরে অবশ্য মেনে নিয়েছে।


বেলা বারোটার দিকে মৃণালিনীকে আনাড়ি হাতে স্নান করিয়ে দিল প্রিয়ন্তি। মেয়েটা জলে বসে খিলখিলিয়ে হাসছে। মাথা মুছে, শরীর মুছিয়ে দিল। ডায়াপার আর জামা পরিয়ে দিয়ে পাউডার কাজল পরিয়ে দিল। রিক্তাদেবীর খুব ভালো লাগলো। বড়বোনটা স্বামী, সংসার, বাচ্চা ফেলে অকৃতজ্ঞের মতো চলে গেছে। আর ছোটো বোনটা এসে কী সুন্দর মেয়ের সমস্ত দায়িত্ব হাসিমুখে পালন করছে। প্রিয়ন্তি মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছে। রিক্তাদেবী ঘরে এসে বসলো। বলল,

“আলমারি ঠাসা তোমার বোনের শাড়ি, জামা-কাপড় রাখা আছে। নতুন গুলো পরে ফেলো। কালনাগিনীটা সবগুলো গহনা নিয়ে পালাইছে। নাহলে ওগুলোও তোমার হতো। চুন্নি আমার ছেলের কষ্টের ইনকাম করা চারলক্ষ্য টাকা আর আমাদের দুইবাড়ি থেকে দেওয়া গহনাগুলো নিয়ে পালাইছে। নাহলেও বারো/তেরো ভরী গহনা ছিল। ওর কোনোদিনও ভালো হইবো না। বাকি জীবন কাঁদতে কাঁদতে যাইবো। ওই কী ভাবছে! অন্যকে কষ্ট দিয়ে সুখী হইবো। আমি তো কেস করতেই বলছিলাম। লোক জানাজানি হয়ে যাইবো দেখে আমার ছেলেই রাজি হইলো না। ছেলের এখন যেখানে পোস্টিং হইছে। সেখানের কেউ জানে না বউ পালাইছে। সরকারি চাকরির এই একগুন বুঝলা। বেশিদিন এক জায়গা থাকা লাগে না। হিরের টুকরো ছেলে আমার। ওর জন্য কী মেয়ের অভাব হইবো। কোনোদিনও হইবো না। তোমার থেকেও সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করাইতে পারতাম। কিন্তু করাইনি। নাহলে আমার নাতনিটা মা হারা হতো। কোনোদিনও মায়ের আদর পাইতো না। তুমি তো মাসি। ছোটোবেলা থেকে মৃণালিনীকে দেখছো। ওর প্রতি তোমার অন্যরকম একটা টান আছে। আমি জানি। এরজন্যই তোমাকে বউ করে আনছি। তুমি এমন কিছু কইরো না। যেন আমার ছেলেটা আবারও অপমানিত হয়। এবার যদি আমি উল্টাপাল্টা কিছু শুনি। তাহলে আর তোমাদের কাউকে ছেড়ে দেব না।”

খুব ঠাণ্ডা ভাবে প্রিয়ন্তিকে থ্রেড দিল রিক্তাদেবী। প্রিয়ন্তির অনেককিছুই বলার ছিল। নতুন বউ দেখে অপমানগুলো মুখ বুজে হজম করে নিল। রিক্তাদেবী আরও কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেল।

প্রিয়ন্তি ভেবেছিল রাতুল আসবে। প্রিয়ন্তিকে নিরাশ করে দিয়ে রাতুল সত্যি সত্যিই এলো না। আর ফোনও দিল না।


রাতে নামে, ভোর হয়। দিন ফুরোয়, প্রিয়ন্তির সাদামাটা দিনগুলো মৃণালিনীকে নিয়ে বেশ কেটে যাচ্ছে। তবে সেদিনের পর থেকে রাতুল একবারের বেশি প্রিয়ন্তিকে ফোন দেয় না। ফোন দিয়ে দুই চার মিনিট মৃণালিনীর কথা জিজ্ঞেস করে ফোন রেখে দেয়। এমন জীবন তো প্রিয়ন্তি চায়নি। সব দোষ দিদির। দিদির জন্য ওর সাজানো গোছানো সুন্দর জীবনটা আষাঢ়ের মেঘে ঢেকে গেছে। রাতুলের কাছে কোনো রকম আশা রাখতে চায় না প্রিয়ন্তি। তবে অবাধ্য মন যে মানে না।

ওদের বিয়ের একমাস হতে চলল। অথচ এখনো রাতুল আর আসেনি। এই বাড়িতে তেমন কোনো কাজ নেই। তবে টুকিটাকি রান্না করে, নিজেদের ঘর গুছিয়ে রাখা আর বাকি সময়টুকু মৃণালিনীর সাথেই কেটে যায়। তবুও মনের কোথাও না কোথাও রাতুলের জন্য অস্থির বোধ করে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কই বোধহয় এমন। না চাইতেও অপরপক্ষের মানুষটার জন্য অঘোষিত মায়া জন্মে যায়। তীব্র আকর্ষণ বোধ হয়। এই মায়ার টানই তো বড্ড খারাপ। 


রিক্তাদেবী প্রিয়ন্তির ব্যবহারে মুগ্ধ। প্রিয়ন্তির বড়ো বোনটাও অবশ্য লক্ষ্মীমন্ত ছিল। তবে পেটে পেটে যে এত শয়তানি পুষে রেখেছিল। কে জানতো! থাক তা আর জানার দরকার নেই। যা হয় ভালোর জন্যই হয়। একদিন প্রিয়ন্তিকে ডেকে বলল,

“মৃণালিনীকে একা একা পালতে পারবে?”

এই একমাস যাবৎ একা হাতেই মৃণালিনীকে পালছে প্রিয়ন্তি। তারপরও এই কথা কেন বলছে ওনি? প্রিয়ন্তির খুব বলতে ইচ্ছে করলো। একাই তো পালি মৃণালিনীকে। তবে কোনো এক অদৃশ্য জাদুবলে মনের কথা মনেই রয়ে গেল। মুখ ফুটে আর বলা হলো না। রিক্তাদেবী বলল,

“এখানে তো আমি আছি, রিতু আছে, বিমলা আছে। সংসারের কাজ নিয়ে তোমাকে খুব বেশি ভাবতে হয়নি। তবে রাতুলের কাছে চলে গেলে প্রথম প্রথম একা হাতেই তোমাকে সংসার, বাচ্চা সামলাতে হবে।”

প্রিয়ন্তি চমকে উঠল। বুকের ভেতর তিরতির করে কেঁপে উঠল কী? উঠল বোধহয়। নাহলে বুক ধড়ফড় করছে কেন! সত্যি সত্যিই রাতুলের কাছে চলে যাবে প্রিয়ন্তি? রাতুল, রাতুল, রাতুল, এই একমাসে মানুষটাকে নিয়ে এতবেশি ভেবে ফেলেছে প্রিয়ন্তি। না চাইতেও মনের গভীরে মানুষটার জন্য সফট্ কর্ণার তৈরি হয়ে গেছে। তাছাড়া এই ঠকে যাওয়া মানুষটাকে আর কখনো কোনো কষ্ট পেতে দেবে না প্রিয়ন্তি। ওনিও তো একটা সুন্দর, ছিমছাম সংসার ডিজার্ভ করে।

রিক্তাদেবী বলল,

“তোমাকে আমার ছেলেটা কিছুতেই বিয়ে করতে চায়নি। আমরাই একপ্রকার জোর করে রাতুলকে তোমাকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছি। আসলে হাজার হলেও তুমি সায়ন্তির বোন তো। তাই আমার ছেলেটা বোধহয় এই বিয়েটা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। নাহলে ছুটি থাকা সত্বেও ওভাবে করে চলে যেত না। এই একমাসে ফোনে কতবার বলেছি। একবার এসে অন্তত ঘুরে যা। ছেলেটা নানান বাহানা করে। কিছুতেই বাড়ি আসতে চায় না। এভাবে দুজন দূরে দূরে থাকলে তোমাদের সম্পর্ক কোনোদিনও ঠিক হবে না। তাই আমি আর তোমার শ্বশুর মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আগামীকাল তোমাকে রাতুলের কাছে রেখে আসব।”

এই প্রথম শাশুড়ী নামক মানুষটার জন্য মন থেকেই শ্রদ্ধা চলে এলো। সত্যিই এমন করে যদি প্রতিটা বাবা-মা ভাবতো৷ তাহলে সম্পর্কগুলোও খুব সুন্দর হতো। রিক্তাদেবী আবারও বলল,

“ব্যাগ গুছিয়ে নিও। তোমার শ্বশুর গাড়ি ঠিক করে ফেলেছে। আগামীকাল রাতে রওনা হবো আমরা।”

প্রিয়ন্তি মাথা নেড়ে আচ্ছা বলল। রাতুলের কাছে যাওয়ার কথা শুনে ওর এত ভালো লাগছে কেনো তাই তো বুঝতে পারছে না প্রিয়ন্তি।


রাতে মৃণালিনীকে ঘুম পাড়িয়ে মনের সুখে ব্যাগ গোছাতে লাগল প্রিয়ন্তি। এমন সময় রাতুল ফোন দিল। সারাটাদিন চাতক পাখির মতো এই একটা ফোনকলের অপেক্ষায় থাকে প্রিয়ন্তি। মানুষটার কণ্ঠে জাদু আছে। দু'চার মিনিট কথা বললেও মনটা প্রশান্তিতে ভরে যায়। আজকাল মানুষটাকে নিয়ে ভাবতেও খুব ভালো লাগে। রাতুলের ফোন রিসিভ করতেই রাতুল বলল,

“কী ব্যাপার আজ ফোন দেওয়ার সাথে সাথে রিসিভ করলে যে?”

“কবে দুইবার ফোন দিয়েছেন আমাকে?”

“তা দেইনি। যাইহোক আমার মৃণালিনী মা কেমন আছে?”

“ভালো আছে।”

“আর তার মা?”

কথাটা প্রিয়ন্তির বুকে এসে লাগল। নিঃশ্বাসের গতিবেগ দ্রুত বেড়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে আস্তে করে বলল,

“ভালো আছে মৃণালিনীর মা। মৃণালিনীর বাবা কেমন আছে?”

“ভালো নেই।”

“কেন?”

“মাথা ব্যথা করছে। এদিকে অনেক কাজ জমে আছে। ঘুমাতেও পারছি না।”

“একটা ঔষধ খেয়ে নিন।”

“খেয়েছি। কাজ হচ্ছে না। আমার তো আর বউ ভাগ্য নেই। যে মাথাটা টিপে দেবে।”

“দোষটা কার?”

“দোষটা তোমার প্রিয়ন্তি।”

“আমি কী করেছি?”

“আবারও ঠকে যাওয়ার ভয়েই তো আমি তোমার কাছে যাই না।”

“তাহলে আরেকটা বিয়ে করে নিন।”

“তুমি আমার ইমেজের বারোটা বাজিয়ে দিতে চাও নাকি?”

“কেন?”

“এক বউ থাকতে আবার বিয়ে করলে লোকে কী বলবে।”

“ওখানে তো আর আপনাকে সেভাবে কেউ চিনে না।”

“তা অবশ্য ঠিক। তাহলে একটা বিয়ে করাই যায় কী বলো?”

প্রিয়ন্তির প্রচণ্ড রাগ লাগছে। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

“করে ফেলুন।”

“অনুমতি দিচ্ছো তাহলে?”

মেজাজ চড়ে গেল প্রিয়ন্তির। এই বিষয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মানুষটা কী প্রিয়ন্তিকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ইচ্ছে করে এই ধরনের কথা বলছে। 

রাতুল ফিসফিস করে বলল,

“আমি এতটাও খারাপ না প্রিয়ন্তি। ঘরে বউ থাকতে আবারও বিয়ে করব। ঘরের বউকে আগে মুক্ত করে দেব। তারপর নতুন করে বিয়ে করার কথা ভাববো।”

প্রিয়ন্তি তেজি কণ্ঠে বলল,

“কে মুক্তি চায় আপনার কাছে?”

“সত্যিই মুক্তি চাও না?”

প্রিয়ন্তি স্পষ্ট করে বলল,

“না।”

“তাহলে?”

“তাহলে কী?”

“তাহলে আমার বউ হয়েই সারাজীবন থাকবে?”

প্রিয়ন্তির বুক দুরুদুরু করছে। আর কীভাবে বুঝালে বুঝবে এই মানুষটা? বাবা-মা ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিলেও এখন মনেপ্রাণে এই মানুষটাকেই স্বামী বলে মানে প্রিয়ন্তি। প্রিয়ন্তি বলল,

“জানি না।”

“তারমানে সুযোগ পেলে তুমিও ভেগে যাবে?”

প্রিয়ন্তি শত চেষ্টা করেও মেজাজ ঠিক রাখতে পারলো না। রাগী কণ্ঠে বলল,

“সবাইকে আপনার বউয়ের মতো ভাবেন নাকি?”

“তুমিও তো আমার ‘বউ’ প্রিয়ন্তি।”

প্রিয়ন্তি চুপ হয়ে গেল। মানুষটা আজ তবে স্বীকার করলো। প্রশান্তিতে প্রিয়ন্তির ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি ফুটে উঠল। গাল দুটো লজ্জারাঙা হলো। বুকের ভেতর সুখ সুখ শিহরণ জাগানো উষ্ণ অনুভূতি। প্রিয়ন্তি বলল,

“বাড়ি আসবেন কবে?”

“ঠিক নেই।”

“কেন?”

“কীসের টানে বাড়ি যাব।”

“আপনার বাবা-মা, বোন, মেয়ে, বিশেষ করে আপনার মেয়ের টানে বাড়ি আসবেন।”

“মেয়েকে দেখে রাখার জন্য তুমি তো আছো।”

“আমি থাকলেই কী! বাবা হিসাবে আপনার একটা দায়িত্ব আছে না!”

“সময় হলে দায়িত্ব পালন করবো।”

“তাও ঠিক।”

“এখন ঘুমাও প্রিয়ন্তি। রাখি!”

“শুনুন?”

“বলো?”

“না..কিছু না।”

“কিছু বলবে প্রিয়ন্তি?”

“কিছু না।”

“আচ্ছা রাখি।”

“বাই। শুভরাত্রি।”

“সেম টু।”


একটু একটু করে রাতের আঁধার সরে গিয়ে ভোর হলো। নিত্যদিনের মতো আজও স্নান করে বাবুর খাবার তৈরি করা, পূজো দেওয়া, বাবুর কাঁথা কাপড় ধুয়ে দেওয়া, বাবুকে সময় মতো খাওয়ানো, স্নান করানো, নিজের খাওয়া, মায়ের সাথে ফোনে কথা বলা। এসব করেই সারাটাদিন কাটলো প্রিয়ন্তির। বিকালের দিকে মেয়েকে রেডি করে দিল। নিজেও রেডি হয়ে নিল। 


রাতুলের বাবা-মা, বোন, প্রিয়ন্তি ও রাতুলের মেয়ে মৃণালিনী ওরা সবাই এই প্রথম যাচ্ছে রাতুলের বাংলো বাড়িতে। রিতু বলেছে, হঠাৎ গিয়ে দাদাভাইকে সারপ্রাইজ দেব। তারজন্য রাতুলকে আগে থেকে বলা হয়নি। ওরা একটা দিন থেকে প্রিয়ন্তি আর মৃণালিনীকে রাতুলের কাছে রেখে আসবে। এই একমাসে হোক না অল্প সময়ের জন্য রাতুলের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে অন্যরকম একটা টান অনুভব করে প্রিয়ন্তি৷ বেখেয়ালে রাতুলকে নিয়ে ভাবতেও মন্দ লাগে না। এখন আর মনেই হয় না। একসময় রাতুল শুধুই দিদির বর ছিল। এখন ওর ও খুব আপন মনে হয় রাতুলকে। স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনটাই যে জোড়ালো। 


ওরা যখন বাংলোতে পৌঁছালো, তখন রাত নয়টা বাজে। রাতুল ঘরের দরজা বন্ধ করে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে ছিল। বাবার ফোন পেয়ে ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে ফোনটা রিসিভ করলো।

“হ্যালো বাবা!”

বাবা রাতুলকে বলল,

“কইরে রাতুল তুই? আমরা তোর বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। জলদি চলে আয়।”

রাতুল চট করে উঠে দাঁড়ালো। ঘরের দরজা খুলে যেতে যেতে বাবাকে বলল,

“দাঁড়াও আমি এখুনি আসছি। বলে আসবা না তোমরা?”

দুই মিনিট সময় লাগল রাতুলের বাংলোর গেইটে আসতে। পরিবারের সবাইকে হঠাৎ একসাথে দেখে এত ভালো লাগলো রাতুলের। প্রশান্তিতে মনটা জুড়িয়ে গেল। মৃণালিনীকে কোলে তুলে নিয়ে কপালে চুমু এঁকে দিল। একহাত দিয়ে মায়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরে হাসি হাসি মুখে বলল,

“তোমরা বলে আসবা না? আমার তো এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না।”

রিতু বলল,

“বলে এলে কী আর সারপ্রাইজ থাকতো দাদাভাই?”

“তাও ঠিক।”

“চলো..চলো ভেতরে চলো!”


এতরাতে বুয়াও থাকে না। যে রাতুল বলবে একটু ভাত, তরকারি রান্না করে দিতে। এখন খাবার অর্ডার দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। এতরাতে তো আর ভাত-তরকারি পাওয়া যাবে না। তবে সামনের মোড়ের বিরিয়ানি হাউজ খোলা থাকতে পারে। রাতুল ফোনটা হাতে তুলে নিল। বাংলোর দারোয়ানকে ফোন দেওয়ার জন্য। মা বলল, 

“এখন কাকে ফোন দিচ্ছিস রাতুল?’’

“না বলে এসেছো। এখন এত খাবার কোথায় পাব! দেখি হোটেল মোটেলে কি খাবার পাওয়া যায়। তোমরা বরং এই ফাঁকে পোশাক পাল্টে ফ্রেশ হয়ে নাও।”

“কাউকে ফোন দেওয়া লাগবে না। আমি সাথে করে সব খাবার নিয়ে এসেছি। শুধু ভাতটা রান্না করে নিলেই হবে। তোর রান্নাঘরটা কোথায়?” 

“রান্নাঘর নিচতলায়।”

“উপরে আসার সময় দেখলাম না তো?”

“ভেতরের দিকে।”

“আচ্ছা আগামীকাল ঘুরে ঘুরে দেখব। বউমা মৃণালিনী আর খাবে না?”

প্রিয়ন্তি আস্তে করে বলল,

“ঘুমিয়ে পরেছে। উঠলে শুধু দুধ খাইয়ে দেব।”

“ফ্ল্যাক্সে তো গরম জলও নেই। তুমি বরং এককাজ করো। রাতুলের সাথে রান্নাঘরে গিয়ে ছোটো মণির জন্য জল গরম করে আনো। আর ভাতটাও একটু কষ্ট করে রেঁধে নিও। তিন পোয়া চাল মেপে রাইস কুকারে বসিয়ে দিও। টাইম লাগবে না।”

প্রিয়ন্তি বলল,

“শাড়িটা পাল্টে নেই মা।”

“আচ্ছা।”

রিতু আর প্রিয়ন্তি অন্যরুমে চলে গেল। দুজনে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে পোশাক পাল্টে নিল। প্রিয়ন্তি পাটভাঙা সুতির শাড়ি পরলো। মুখে ক্রিম মেখে মাথা আছড়ে সিঁদুর পরে নিল। রিতু দুষ্টুমি করে বলল,

“হেব্বি লাগছে বউদি তোমাকে। দাদাভাই তো আজ ফিদা হয়ে যাবে।”

প্রিয়ন্তি লাজুক হেসে বলল,

“ধ্যুৎ..”


এখানে আসার পর থেকে এখনো দুজনের একটাও কথা হয়নি। শুধু কয়েকবার চোখাচোখি হয়েছে। প্রিয়ন্তি রাতুলের শোবার ঘরে যেতেই রাতুল ইশারায় বলল,

“আসো।”

সিঁড়ি দিয়ে ওরা একসাথে নামতে লাগল। রাতুল টাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একপা দুপা করে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। প্রিয়ন্তির মাঝে একরাশ জড়তা। রাতুল বলল,

“কেমন আছো প্রিয়ন্তি?”

এতক্ষণে এই কথাটা জিজ্ঞেস করার সময় হলো মানুষটার? অভিমানে কণ্ঠরোধ হতে চাইলো প্রিয়ন্তির। আস্তে করে বলল,

“ভালো।”

“আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবে না?”

“রান্নাঘরটা কোথায়?”

“চলো দেখিয়ে দিচ্ছি।”

রান্নাঘরে গিয়ে প্রিয়ন্তি বলল,

“চাল কোথায়?”

রাতুল সেকথার উত্তর না দিয়ে নিজেই চাল মেপে ভাত বসিয়ে দিল। তারপর মৃণালিনীর জন্য একটা পরিষ্কার ছোটো পাতিলে গরম জল করতে দিল। প্রিয়ন্তি বলল,

“আমাকে তো কিছুই করতে দিচ্ছেন না। মা শুনলে কী ভাববে!”

“তুমি হলে দুদিনের অতিথি। অতিথিকে দিয়ে কেউ কখনো কাজ করায়?’’

প্রিয়ন্তির মনটা খারাপ হয়ে গেল। রাতুল বলল,

“কী ভাবছো?”

“কিছু না।”


অনেকগুলো দিন পর রাতে সবাই একসাথে খেতে বসলো। রাতুলের খুব ভালো লাগছে। অনেকদিন সবাই একসাথে বসে খাওয়া হয় না। বাড়িতে থাকতে যার যখন খিদে লাগে সে তখন খেয়ে নেয়। তাছাড়া বাবাও লাঞ্চ করতো অফিসে। ছুটির দিন ছাড়া কখনো ওদের একসাথে খাওয়া হতো না। আজ খুব ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছে। প্রিয়ন্তি খেতে খেতে বার বার রাতুলের মুখের দিকে আঁড়চোখে তাকাচ্ছে। এই একমাসে মানুষটা আরও ইয়াং হয়েছে কী? দেখতে খুব সুন্দর লাগছে।”


রাতুলের বেডরুমটা খুব সুন্দর পরিপাটি করে গোছানো। কেউ দেখে বলবেই না। এটা ব্যাচেলর রুম। রাতুলও খুব রুচিশীল মানুষ। খাটটা বেশ বড়ো। তিনজন শুতেও অসুবিধে হবে না৷ বাবা, মা ও রিতুকে শোবার ঘর দেখিয়ে দিয়ে রাতুল নিজের রুমে এলো। দেখল, প্রিয়ন্তি ঘুমন্ত মৃণালিনীকে ফিডার খাইয়ে দিয়ে, বিছানার মাঝখানে শুইয়ে দিচ্ছে। রাতুল ঘরের দরজা বন্ধ করে, বড়ো লাইটগুলো বন্ধ করে দিল। এই ঘরে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ অনুভব করছে প্রিয়ন্তি। জিরো বাল্বের মৃদু আলোতে ঘরের সৌন্দর্য বেড়ে গেছে। রাতুল খাটে উঠে বসতে বসতে বলল,

“মৃণালিনী রাতে আর উঠবে না?”

“না।”

“ও বোধহয় রাতে জ্বালায় কম।”

“হুম।”

“তারপর তোমার কী অবস্থা?”

প্রিয়ন্তি চোখ তুলে তাকালো। আবছায়া আলোতে রাতুলের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। প্রিয়ন্তি ছোটো করে উত্তর দিল, “ভালো।”

রাতুল বলল,

“কিছুদিন থাকবে নাকি? না আগামীকালই বাবা-মায়ের সাথে চলে যাবে?”

“আমি থাকলে আপনি খুশি হবেন?”

রাতুল কথা ঘুরিয়ে বলল,

“খুশি না হওয়ার কী আছে। তুমি থাকলে আমার মেয়েটাকে তো কাছে পাব।”

“মা জানে!”

“কি মা জানে?”

“আমার এখানে থাকার ব্যাপারে।”

“ওহ আচ্ছা।”

“আপনি কয়টায় বাসায় ফিরেন?”

“ঠিক নাই। একেকদিন একেক টাইমে।”

“ওহ।”


হঠাৎ রাতুল প্রিয়ন্তির একহাত ধরলো। প্রিয়ন্তি কেঁপে উঠল। গলা শুকিয়ে গেল। শুকনো ঢোক গিলল। অজানা শিহরণে শরীরের রক্তকণিকা টগবগ করে ফুটছে। রাতুল বলল, 

“এত দূরে দূরে থাকো কেন? কাছে আসো?”

প্রিয়ন্তি নিজেকে সামলে নিল। বলল,

“আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”

রাতুলের খারাপ লাগলো। তবে প্রকাশ করলো না। আস্তে করে প্রিয়ন্তির হাতটা ছেড়ে দিল। বলল,

“ঘুমাও।”

প্রিয়ন্তির মনটা শরতের মেঘে ঢেকে গেল। মনে মনে বলল,

“একটু জোর করেও তো কাছে টানতে পারতো! নিজে থেকে কী কাছে যাওয়া যায়! লজ্জা লাগে তো। এই লোকটা কী কোনোদিনও আমার মন বুঝবে না!”


প্রিয়ন্তি গুটিশুটি মেরে খাটের একপাশে শুয়ে পরলো। রাতুল এপাশ-ওপাশ করছে। ওর কিছুতেই ঘুম আসছে না৷ প্রিয়ন্তিকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। সায়ন্তি চলে যাবার পর অনেকদিন তো একা একা থেকেছে রাতুল। কখনো এতটা খারাপ লাগেনি। নারী শরীর এতটা কাছে এসেছে। অথচ ছুঁতে না পারার যন্ত্রণায় শরীর পুড়ে যাচ্ছে। রাতুল কী প্রিয়ন্তিকে জোর করে কাছে টেনে নেবে? প্রিয়ন্তি কী ভাববে। ওর তো রাতুলের সঙ্গ ভালো নাও লাগতে পারে। মন ও মস্তিষ্কের সাথে এই নিয়ে অনেকক্ষণ দণ্ড চলল। একসময় মনের জয় হলো। প্রিয়ন্তি যা খুশি ভাবুক। ওরা তো এখন স্বামী-স্ত্রী। প্রিয়ন্তির উপরে সম্পূর্ণ অধিকার আছে রাতুলের। রাতুলের পাশে একটা বড়ো কোলবালিশ দিয়ে মৃণালিনীকে একপাশে শুইয়ে দিল। তারপর রাতুল উঠে মাঝখানে চলে গেল। প্রিয়ন্তিকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“কী ব্যাপার এখানে আসার পর থেকে খুব একটা কথা বলছো না কেন? ফোনে তো সারাক্ষণ ঝগড়ার মুডে থাকো।”

প্রিয়ন্তির শরীর শক্ত হয়ে উঠল। ও এখন কিছুতেই নিজেকে অনুভূতির সাগরে ভাসাবে না। ওর রাতুলের উপরে অনেক অভিমান জমে আছে। রাতুল এখনো প্রিয়ন্তির ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নেয়নি। অথচ সেসব ভুলে গিয়ে কত সহজেই ঘনিষ্ঠ হওয়ার পায়তারা করছে রাতুল। রাতুল প্রিয়ন্তির ঘাড়ে মুখ গুঁজতেই প্রিয়ন্তির শরীর শিরশির করে উঠলো। মনের দরজা খুলে অনুভূতিরা পরম আনন্দে ছোটাছুটি করতে লাগল। নাহলে রাতুলের স্পর্শে এত কেন বেসামাল লাগছে। রাতুল প্রিয়ন্তির গালে চুমু এঁকে দিতেই রাতুলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল প্রিয়ন্তি। চোখের জল মুছে বলল,

“লজ্জা লাগছে না?”

রাতুল অবাক হয়ে বলল,

“কেন লজ্জা লাগবে! তুমি তো আমার বউ।”

প্রিয়ন্তি ফুঁসে উঠল। রাতুল চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল। প্রিয়ন্তি সামান্য ঝুঁকে আবছায়া অন্ধকারে রাতুলের শার্টের কলার দুইহাতে শক্ত করে চেপে ধরল। কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল,

“আমি খারাপ মেয়ে। আমার ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নিলে আপনার পাপ হবে। সেদিন না বলেই চলে এলেন। তাহলে এখন আমার এত কাছে এসেছেন কেন?”

রাতুল প্রিয়ন্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আদুরে কণ্ঠে বলল,

“কে বলেছে তুমি খারাপ মেয়ে?”

প্রিয়ন্তি মাথা থেকে রাতুলের হাতখানা প্রচণ্ড অভিমানে সরিয়ে দিল। রাতুলের বুকে এক আঙুল রেখে বলল,

“আপনি..আপনি বলেছেন।”

রাতুল শত চেষ্টা করেও মনে করতে পারলো না। বলল,

“কবে বলেছি?”

“কেন বিয়ের দিন।”

রাতুল সন্দিহান কণ্ঠে বলল,

“সত্যিই বলেছিলাম?”

“এখন তো মনে পড়বেই না। আপনি সেদিন বলেননি, কেন যে বেছে বেছে এই ধরনের মেয়েগুলো আমার কপালে জুটে। এই ধরনের মেয়ে বলতে আপনি তো খারাপ মেয়েই বুঝিয়েছেন। আমি কিছু বুঝি না। মনে করেছেন?”

রাতুল মুখ টিপে হাসলো। বলল,

“সে তো তুমি প্রেম করো দেখে বলেছি।”

“করতাম। অতীত।”

“এখন করো না কেন?”

“কারণ ছেলেটা খুব খারাপ প্রস্তাব দিয়েছিল। তাই ব্রেকাপ করে ফেলেছি।”

“সত্যি বলছো?”

“আপনাকে মিথ্যা বলব কেন?”

“তাহলে এখন আর তোমাদের সম্পর্ক নেই বলতে চাচ্ছো?”

“আমার তরফ থেকে নেই। তবে ছেলেটা প্রায়ই বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোন করে আমাকে খুব ডিস্টার্ব করে। আমার বিয়ে হয়ে গেছে জানার পরও।”

“আমাকে জানাওনি কেন?”

“আপনি জানানোর সুযোগ দিয়েছেন?”

“দেখি, নম্বরটা দাও।” 

প্রিয়ন্তি ফোন এনে দেবুর নম্বর বের রাতুলকে দিল। রাতুল ভরসা দিয়ে বলল,

“আর কখনো ডিস্টার্ব করবে না। নিশ্চিন্ত থাকো। এবার কাছে আছো!” 

রাতুল একহাত বাড়িয়ে দিলো। প্রিয়ন্তি জেদি কণ্ঠে বলল,

“না।”

রাতুল প্রিয়ন্তিকে পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে প্রিয়ন্তির ঘাড়ে চিবুক রাখলো। বলল,

“না কেন?”

আবেশে প্রিয়ন্তির বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে উদাস হয়ে বলল,

“আপনি এখনো আমার ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নেননি।”

প্রিয়ন্তির উন্মুক্ত ঘাড়ে গাঢ় একটা চুমু এঁকে দিলো রাতুল। প্রিয়ন্তি শাড়ি মুঠো করে ধরলো। ওর খুব অস্থির লাগছে। প্রিয়ন্তিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল রাতুল। প্রিয়ন্তির কপালে এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিল। আবেশে চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল প্রিয়ন্তি। রাতুল মুখটা প্রিয়ন্তির মুখের খুব কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

“আগামীকাল তোমার ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নেবো।”

রাতুলের মুখের উষ্ণ নিঃশ্বাস প্রিয়ন্তির চোখে-মুখে উপচে পড়ছে। ওর খুব বেসামাল লাগছে। কম্পিত কণ্ঠে বলল,

“তাহলে..”

রাতুল প্রিয়ন্তির গালে এক আঙুল দিয়ে লম্বা রেখা টেনে চিবুকে তিন আঙুর দাবিয়ে, প্রিয়ন্তির লজ্জা রাঙা মুখটা উপরের দিকে টেনে তুললো। বলল,

“তাহলে কী প্রিয়ন্তি?”

প্রিয়ন্তি কথা বলার শক্তি হারিয়েছে। ওর মনে হচ্ছে ও এবার দম বন্ধ হয়ে মরেই যাবে। স্বামী নামক মানুষটা কাছে থাকলে, এত কেন সুখানুভূতি ঘিরে রাখে। রাতুল দুইহাত দিয়ে প্রিয়ন্তির গালদুটো আঁজলায় তুলে ধরলো। বলল,

“আমার চোখের দিকে তাকাও প্রিয়ন্তি?”

প্রিয়ন্তি অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে বলল,

“আমার খুব অস্থির লাগছে জামাইবাবু।”

রাতুল চমকে উঠলো। ওর ঘোর মুহূর্তেই কেটে গেল। এইমাত্র প্রিয়ন্তি কী বলে ডাকলো ওকে? এই প্রথম প্রিয়ন্তির মুখে “জামাইবাবু” ডাকটা শুনে কী বিদঘুটে অনুভূতি হলো। রাতুল প্রিয়ন্তিকে ছেড়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“অনেক রাত হয়েছে। ঘুমাও প্রিয়ন্তি।”


রাতুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বালিশ নিয়ে মৃণালিনীর পাশে গিয়ে শুয়ে পরলো। প্রিয়ন্তির এত কান্না পেল বলার মতো না। শুধুমাত্র ওর বোকামির জন্য ওদের এত সুন্দর একটা মুহুর্ত নষ্ট হলো। খুব কী দরকার ছিলো এত ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে রাতুলকে ‘জামাইবাবু’ বলে ডাকার!


অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলো প্রিয়ন্তি। রাত জাগার ফলে ঘুম থেকে উঠতে একটু বেলা হয়ে গেল। উঠে দেখলো রাতুল রুমে নেই। প্রিয়ন্তি স্নান সেরে এসে দেখলো, মৃণালিনী উঠে গেছে। মৃণালিনীকে ফ্রেশ করিয়ে দিয়ে দুধ খাইয়ে দিলো। তারপর কোলে নিয়ে নিচতলায় নামলো। শাশুড়ীমা রান্না করছে, বাবা একমনে টেলিভিশন দেখছে, রিতু বাবার পাশে সোফায় বসে বসে পায়ে নেইলপালিশ পরছে। রাতুলকে আশেপাশে কোথাও দেখা গেল না। ও কী অফিসে চলে গেছে? মৃণালিনীকে বাবার কোলে দিয়ে রান্নাঘরে গেল প্রিয়ন্তি। রিক্তাদেবীকে বলল,

“কী রান্না করছেন মা?”

“আজ তোমাদের বৌভাতের খুব ছোটো পরিসরে অনুষ্ঠান করবো। তাই কিছু আইটেম রান্না করছি বউমা। বাকি খাবার রাতুল বাইরে থেকে আনিয়ে নেবে।”

প্রিয়ন্তির খুব ভালো লাগলো। বলল,

“মা সবজি আছে?”

“আছে।”

“কোথায় রাখা?”

রাতুলের বাসার কাজের বুয়ার নাম মিনতি। মিনতি সবজিগুলো প্রিয়ন্তির সামনে এনে দিলো। বলল,

“আমি কেটে দেব বউমণি?”

“না। আমি কেটে নেব৷”

রিক্তাদেবী বলল,

“ওর নাম মিনতি। তুমি মিনতিদি বলে ডেকো বউমা।”

“আচ্ছা মা।”

প্রিয়ন্তি সবজি কেটে খিচুড়ি বসিয়ে দিলো। তারপর ডিমসেদ্ধ নিয়ে চলে যেতে লাগলো। রিক্তাদেবী পিছু ডেকে বলল,

“তুমি খেয়ে নাও বউমা।”

“খাব মা। মৃণালিনীকে ডিমটা খাইয়ে দিয়ে আসি।”


মৃণালিনী অর্ধেক ডিম খেয়ে আর খেতে চাইলো না। গল্প বলেও খাওয়াতে পারলো না। রিক্তাদেবী বলল,

“জোর করো না। তুমি খেয়ে নাও।”


প্রিয়ন্তি খেয়ে নিল। রিতু বলল,

“চলো বউদি তোমাকে সাজিয়ে দেই?”

প্রিয়ন্তির খুব লজ্জা লাগছে, আবার ভালোও লাগছে। ও উঠে চলে গেল। রিতু লাগেজ খুলে একটা লাল টুকটুকে জামদানী শাড়ি বের করলো। প্রিয়ন্তি শাড়িটা খুব সুন্দর করে পরে নিলো। রিতু খুব সুন্দর করে প্রিয়ন্তিকে মেকাপ করে দিলো। খোঁপায় তাজা কাঠগোলাপ গুঁজে দিলো। প্রিয়ন্তি বলল,

“এত সুন্দর টাটকা ফুল পেলে কোথায়?”

“বাংলোর বাগান থেকে তুলে এনেছি। বাংলোটা খুব সুন্দর বউদি। দিনে সময় করে ঘুরে ঘুরে দেখো। বসার দোলনা আছে, একটা পুকুর আছে, চারপাশে কত ফুল, ফলের গাছ। কী সতেজ প্রকৃতি। তোমার বেশ কাটবে।”

“তুমিও থেকে যাও রিতু!”

“আমার পড়াশোনা আছে বউদি। নাহলে থাকতাম। ছুটির সময় আসবো।”

“আচ্ছা।”

“এখন চুপ করে বসো। বাকি সাজ টুকু কম্পিলিট করে দেই।”

রিতু খুব যত্ন করে শাড়ির সাথে ম্যাচ করে লিপস্টিক পরিয়ে দিলো। 

পুরো সাজ কম্পিলিট হওয়ার পর প্রিয়ন্তিকে দেখতে এত সুন্দর লাগছে। রিতু দুষ্টুমি করে বলল,

“কী দারুণ লাগছে বউদি তোমাকে। আমিই তো ক্রাশ খাচ্ছি। দাদাভাই দেখলে জাস্ট ফিদা হয়ে যাবে।”

উত্তরে প্রিয়ন্তি লাজুক হাসলো। 


দুপুর দেড়টার দিকে বাংলো বাড়িতে এলো রাতুল। হাতে নতুন শাড়ির প্যাকেট। মাকে ডেকে বলল,

“তোমাদের হলো মা?”

রিক্তাদেবী ভাতের থালাটা সাজিয়ে নিয়ে বসার ঘরে এলো। উঁচু গলায় প্রিয়ন্তিকে ডাকলো। বলল,

“বউমা নিচতলায় আসো। রাতুল এসেছে।”

প্রিয়ন্তি নূপুর পরা আলতা রাঙা পায়ে রিনিঝিনি ছন্দ তুলে হেঁটে এলো। প্রিয়ন্তিকে দেখে রাতুলের দুচোখ জুড়িয়ে গেল। মুগ্ধ দৃষ্টিতে প্রিয়ন্তির মুখপানে ফিরে ফিরে তাকালো। মাথায় ওটা কী ফুল গুঁজেছে? এই ফুলের অনেকগুলো গাছ আছে এই বাংলোতে। কখনো ফুলটাকে সেভাবে দেখা হয়নি। প্রিয়ন্তির খোঁপায় এত কেন মানিয়েছে ফুলটাকে? দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। 

মায়ের কথামতো প্রিয়ন্তি এসে রাতুলের মুখোমুখি দাঁড়ালো। রাতুল ভাত-কাপড়ের থালাটা প্রিয়ন্তির হাতে তুলে দিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

“আজ থেকে তোমার সমস্ত দায়িত্ব আমি নিলাম প্রিয়ন্তি। বিনিময়ে তুমি শুধু আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখো।”

অবশেষে প্রিয়ন্তির অপূর্ণ চাওয়া পূর্ণতা পেলো। দুজন এক থালায় খেতে বসে খুব বেশি খেতে পারলো না প্রিয়ন্তি। রাতুল খেতে খেতে সুযোগ বুঝে নিচু কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,

“শাড়িটা চেঞ্জ করো না। তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।”


রিক্তাদেবী বলল,

“আর একটু ভাত দেই বাবা?”

“না মা।”

“আমরা আজ সন্ধ্যায় চলে যাব।”

রাতুল প্রিয়ন্তির দিকে একপলক তাকালো। বাবা-মা চলে গেলে তো ওদের সাথে প্রিয়ন্তিও চলে যাবে। আশ্চর্য রাতুলের এত অস্থির লাগছে কেন? রাতুল বলল,

“আজ থাকো মা।”

“তোর বাবা গাড়ি বলে দিয়েছে। তার নাকি এখানে ভালো লাগছে না।”

রাতুলের খাওয়ার রুচি চলে গেল। বলল,

“একদিনে আর কী হবে! বাবাকে গাড়ি মানা করে দিতে বলো।”

“না বাবা। রিতুর সামনে পরীক্ষা। রিতুর পরীক্ষা শেষ হলে কিছুদিন এসে থেকে যাবো।”

রাতুল আর কী বলবে ভেবে পেল না। ওর অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে। এখন আর অফিসেও যেতে ইচ্ছে করছে না। আজ একটা জরুরি মিটিং আছে। এদিকে একটা প্রকল্পে ইনভাইট করেছে। খুব বিনয়ের সাথে অন্তত দুটো ঘণ্টা সময় তাদের দিতে হবে বলেছে। এখন আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। চক্ষুলজ্জার জন্য আগ বাড়িয়ে বলতেও পারছে না। যে প্রিয়ন্তি মৃণালিনীকে নিয়ে এখানে কিছুদিন থাকুক। রাতুল হাত ধুয়ে উঠে পরলো। মৃণালিনীকে কিছুক্ষণ আদর করে দিল। মাকে আবারও বলল,

“আগামীকাল যেও মা।”

“আবার আসব বাবা।”

“তোমরা কখন যাবে?”

“বিকালে রওনা হবো।”

“তখন তো আমি আসতেও পারব না। আমার একটা মিটিং আছে। তাছাড়া একটা প্রকল্পেও যেতে হবে।”

“বেশ তোর আর আসা লাগবে না। ছুটি পেলে একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসিস।”

রাতুল প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে বলল,

“যাব মা।”


এখন প্রিয়ন্তিকে কিছু সময়ের জন্য খুব একা পেতে ইচ্ছে করছে। এদিকে মায়ের সামনে বলতেও পারছে না। একটু ঘরে চলো প্রিয়ন্তি। আবার এই বিরহ সহ্য করতেও পারছে না। আগে কতবার প্রিয়ন্তির সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। এমন অদ্ভুত অনুভূতি তো কখনো হয়নি।

রাতুল মিথ্যে করে বলল,

“আমার ফোনটা বোধহয় ঘরে ফেলে এসেছি। তুমি একটু ফোনটা এনে দেবে প্রিয়ন্তি?”

“দিচ্ছি।”

প্রিয়ন্তি ধীর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঘরে চলে গেল। রাতুল বার বার ঘড়ি দেখছে। একা একাই বলল,

“ওর আসতে এতো দেরি হচ্ছে কেন? বোধহয় ফোনটা খুঁজে পাচ্ছে না। না.. আমি গিয়েই নিয়ে আসি। আমার এমনিতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে।”


রাতুল সিঁড়ি বেয়ে তড়তড়িয়ে উপরে উঠে চলে গেল। ঘরের দরজা সামান্য চাপিয়ে দিয়ে প্রিয়ন্তির পেছনে গিয়ে দুইহাত আড়াআড়ি ভাবে রেখে দাঁড়ালো। রাতুলের উপস্থিতি টের পেল প্রিয়ন্তি। ওর বুক কাঁপছে। নিচু কণ্ঠে বলল,

“আপনার ফোনটা খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় রেখেছেন?”

রাতুল প্রিয়ন্তিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে খোঁপায় মুখ গুঁজলো। নিঃশ্বাসে টেনে নিলো প্রিয়ন্তির চুলের সুন্দর সুবাস। নেশা জড়ানো কণ্ঠে বলল,

“চুলে কী শ্যাম্পু করেছো? এত মিষ্টি ঘ্রাণ।”

প্রিয়ন্তি শুকনো ঢোক গিললো। পেটের ভেতর কী যেন কামড়ে ধরেছে। অস্ফুট স্বরে বলল,

“ছাড়ুন!”

রাতুল ছাড়ার বদলে আর একটু গভীর ভাবে প্রিয়ন্তিকে জড়িয়ে ধরলো। বলল,

“ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।”

“দরজা খোলা। কেউ দেখে ফেলবে।”

“দেখুক।”

“(নিশ্চুপ।)”

“তুমি আজ চলে যেও না প্রিয়ন্তি প্লিজ?”

“থেকে কী করব?”

“আমার জন্য থাকবে।”

“কেন থাকবো?”

রাতুল প্রিয়ন্তিকে নিজের সামনে ঘুরিয়ে নিল। দুজনের মাঝখানে যতটুকু দুরত্ব ছিলো। তা এক নিমিষেই মিলিয়ে দিলো। প্রিয়ন্তির কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,

“আমার চোখের দিকে তাকাও প্রিয়!”

ওই গভীর চোখে বেশিক্ষণ চোখ মেলানোর সাহস হলো না প্রিয়ন্তির৷ দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো। রাতুল মরিয়া হয়ে বলল,

“মাকে গিয়ে বলবে, তুমি এখানে কিছুদিন থাকতে চাও।”

রাতুলের আকুলতা প্রিয়ন্তির খুব ভালো লাগছে। হাসি লুকিয়ে মিথ্যে করে বলল,

“কেন বলব? আমি তো থাকতে চাই না।”

“আমার জন্য বলবা।”

“আপনি বলুন।”

“তুমি বললে কী সমস্যা?”

“আমি পারব না।”

প্রিয়ন্তিকে দূরে ঠেলে দিয়ে অভিমান করে রাতুল বলল,

“বেশ চলে যাও তবে।”

Post a Comment

Previous Post Next Post